মুড়ি খাওয়া নিয়েই আস্ত একটি মেলা। মাঘ মাসের ৪ তারিখ বাঁকুড়ার মুড়ি
প্রিয় মানুষ জড়ো হন কেঞ্জাকুড়া
দ্বারকেশ্বর নদীর চরে সঞ্জীবনী মাতার মন্দিরে। স্থানীয়ভাবে
এই মেলার নাম মুড়ি মেলা। সঞ্জীবনী ঘাটে
মেলাটি হয় বলে কেউ কেউ এই মেলাকে সঞ্জীবনী মেলা বলে থাকেন। প্রতি বছর ১লা মাঘ চব্বিশ প্রহর ব্যাপী হরিনাম সংকীর্তন এর মধ্যে দিয়ে শুরু হয় এই মেলা, আর শেষ
হয় ৪ঠা মাঘ। চারদিন মেলা
থাকলেও আসল ভিড় হয় শেষ দিন, অর্থাৎ ৪ঠা মাঘ। আশেপাশের এলাকার তিন থেকে
চারটি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রায় ৫০–৬০টি গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ এদিন সকাল থেকেই দলে দলে কেঞ্জাকুড়া দ্বারকেশ্বর নদীর
চরে সঞ্জীবনী মাতার মন্দিরে চলে আসেন মুড়ি নিয়ে।
বলা হয় এই মেলা চলে আসছে আজ প্রায়
২০০ বছর ধরে। কয়েক বছর আগে অবধিও আশেপাশের এলাকার ৮–১০টি গ্রামের মানুষই আসতেন এই মেলায়।
মুড়ি খেয়ে দুপুরের মধ্যেই মেলা শেষ হয়ে যেত। কিন্তু গত ৮–৯ বছর এই মেলা জনসমুদ্রের রূপ নিতে
শুরু করেছে। এই অভিনব মুড়ি মেলার টানে ছুটে আসেন পাশের জেলা পুরুলিয়া, দুর্গাপুর, বর্ধমান
আর মেদিনীপুরের মানুষও। বহু দূরদূরান্ত থেকে কেবল মুড়ির টানে দ্বারকেশ্বর নদীর ধারে
এসে আনন্দে গা ভাসান অসংখ্য মানুষ। এই মেলায় বেচাকেনার ব্যবস্থা তেমন নেই বললেই চলে।
মুড়ির সঙ্গে সঙ্গে শসা, ছোলা, কাঁচা লঙ্কা, ধনে পাতা, পেঁয়াজ, চপ, চানাচুর, নারকেল
কিংবা গুড়, বাতাসা সবই যে যার মতন করে নিয়ে আসে বাড়ি থেকে। বর্তমানে সময় পালটেছে। বদলে
গেছে মানুষের রুচিও। এখন প্রতি বছর কেঞ্জাকুড়ার এই উৎসবে স্থানিয় মানুষজনের উদ্যোগে
মেলায় ঘুরতে আসা যাত্রীদের জন্য থাকে খিচুড়ির ব্যবস্থা। বিকাল পর্যন্ত চলে খিচুড়ি খাওয়ার
পালা। এক কথায় একটা দিন একটু অন্যরকমভাবে কাটানোর জন্য এই মেলা অনবদ্য। আপনারাও ঘুরে
মুখ বদলের জন্য ঘুরে আসতে পারেন।
এই মেলাকে নিয়ে বেশ কিছু কাহিনী প্রচলিত আছে
–
ক) একটা সময় লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে এই এলাকা
ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। বহু প্রাচীন কাল থেকে
মকর সংক্রান্তিতে সঞ্জীবনী মাতার বাৎসরিক পুজো উপলক্ষে অনেক মানুষ এখানে জড়ো হতেন।
তখনও বহু দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা হরিনাম শুনতে আসতেন এই মন্দিরে। বণ্য জীবজন্তুর ভয়ে
রাতে তাঁরা নিজেদের গ্রামে ফিরতে পারতেন না। সারারাত জেগে নামগান শুনতেন। পরের দিন
সকালে দ্বারকেশ্বরের জলে সঙ্গে আনা মুড়ি আর বাতাসা ভিজিয়ে খেয়ে যে যার বাড়ি ফিরে যেতেন।
ভক্তদের সেই মুড়ি খাওয়ার রেওয়াজই আজ পরিণত হয়েছে উৎসবে।
খ) শোনা যায় এই মেলা প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন
এলাকার ভান্ডারবেড় গ্রামের জমিদার পরিবারের সদস্য শ্রীযুক্ত রায়কিশোর চট্টোপাধায়। জমিদার
পরিবারে জন্ম হলেও তিনি যুবক বয়সেই সন্ন্যাস নিয়ে তীর্থক্ষেত্রে চলে যান। অনেক পরে
জমিজমা সংক্রান্ত ব্যপারে অন্য ভাইদের মধ্যে বিরোধ আরম্ভ হলে, তাঁকে কিছু দিনের জন্য
ফিরে আসতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি ফিরে এসে কারও বাড়িতে বাস করতে চাননি। তখন তাঁর জন্য
দ্বারকেশ্বর নদের তীরে বাড়ি বানিয়ে দিতে দেওয়া হয়েছিল। সেই বাড়িই এখন সঞ্জীবনী মন্দিরে
রূপান্তরিত।
গল্প যাই হোক না কেন, একদিনের ভ্রমনের যাঁরা
খোজ করেন তাঁরা অবশ্যই একবার ঘুরে আসুন এই মেলায়। রথ দেখা কলা বেচা দুটোই হবে বলে
আমার বিশ্বাস।
কিভাবে যাবেন –
কলকাতা থেকে প্রায় 220 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত
এই মন্দিরে যেতে হলে আপনাকে নামতে হবে ছাতনা স্টেশনে। হাওড়া থেকে ট্রেনে প্রায় চার
ঘণ্টা সময় লাগে ছাতনা পৌঁছতে। ছাতানা থেকে এই মন্দিরের দূরত্ব 17 কিমি।
সাঁতরাগাছি থেকে সকাল 6:25 মিনিটে ছাড়ে রূপসী
বাংলা এক্সপ্রেস। ছাতনা পৌছায় বেলা 10:15 মিনিট নাগাদ।
স্থানিয় যোগাযোগ ব্যবস্থা - ছাতনা এবং বাঁকুড়া থেকে সকালে টেকার, টোটো, বাস পাওয়া যায় পর্যাপ্ত
পরিমাণে।
বাঁকুড়া বাস স্ট্যান্ড থেকে দূরত্ব 15 কিমি।
Comments
Post a Comment